১৪ জানুয়ারি ২০২৫ , ৩০ পৌষ ১৪৩১ 

শিক্ষা

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণ

সিলেটে কাজ না করেই ১৫ কোটি টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

প্রকাশিত: ০৭:০১, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫

সিলেটে কাজ না করেই ১৫ কোটি টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা

সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার বীর মঙ্গল উচ্চ বিদ্যালয়ে পাঁচ তলা ভবন নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, দেড় বছরের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা হয়নি। অথচ বিলের সিংহভাগ টাকাই তুলে নিয়েছেন ঠিকাদার। এই অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) আওতাধীন সিলেট জেলা কার্যালয়ে।

শুধু বীরমঙ্গল উচ্চ বিদ্যালয় নয়, সিলেট জেলার অন্তত ৮০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণে ‘বিধি বহির্ভূতভাবে’ অগ্রিম বিল দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ১৫ কোটি টাকার বেশি। আর এসব ঘটনা ঘটেছে ২০২১-২০২২ এবং ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে। ইইডির সিলেট জেলা অফিসের নথিপত্র ঘেঁটে এসব তথ্য জানা যায়।

ইইডি সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, নতুন ভবন নির্মাণ, বিদ্যমান ভবনের সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত, সংস্কার এবং আসবাব সরবরাহ করে। এ ছাড়া মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও আইসিটি ল্যাব স্থাপন, ইন্টারনেট সংযোগ, আইসিটি সুবিধা দেওয়ার কাজও করে থাকে অধিদপ্তরটি।

এ ছাড়া সিলেট জেলায় বিগত ৫ বছরে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলোর বেশির ভাগই নিম্নমানের। যা উঠে এসেছে শিক্ষামন্ত্রনালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। গত ২৪ নভেম্বর তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সার্বিকভাবে বিগত ৫ বছরে ইইডি সিলেট জেলায় বাস্তবায়িত/বাস্তবায়নাধীন কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। দীর্ঘদিন আগে কার্যাদেশ দেওয়া হলেও অধিকাংশ কাজ এখনো শেষ হয়নি।

সার্বিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গতকাল বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনটি আমি এখনো দেখিনি। আমার নির্দেশনা রয়েছে যেখানেই অনিয়ম হয়েছে তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার।

তিনি আরও বলেন, এসব অনিয়ম রোধে কিছুটা আমরা পদক্ষেপ নেব কিছু ক্ষেত্রে দুনীতি দমন কমিশনের সহযোগিতা নেব।

নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, বীরমঙ্গল উচ্চ বিদ্যালয়ে পাঁচ তলা ভবন নির্মাণের কাজ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স কুশিয়ারা টেডিং। এ কাজের ব্যয় ধরা হয় ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ৭০ শতাংশ। অথচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা বিল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে। কাজের হিসেবে প্রায় ৩০ লাখ টাকা অগ্রিম বিল দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এ বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ কাজের গুণগতমান সন্তোষজনক নয় বলেও শিক্ষামন্ত্রনালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইইডি সূত্র বলছে, সরকারি কাজে ঠিকাদারদের অগ্রিম বিল দেওয়ার বিধান নেই। কাজের অগ্রগতি অনুযায়ী বিল দেওয়া হয়। অর্থাৎ যে পরিমাণ অর্থের কাজ শেষ হয়, সে পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করা হয়। কিন্তু সিলেট জেলায় নির্মাণ কাজের বিল দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন নিয়মকানুনই মানা হয়নি। যা ইইডিতে ওপেন সিক্রেট।

অগ্রিম বিলের বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিলেট জেলার এক সহকারী প্রকৌশলী বলেন, সিলেট জেলার কমপক্ষে ৮০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণকাজে ১৫ কোটি টাকার বেশি অগ্রিম বিল দেওয়া আছে। এ ক্ষেত্রে কোনো নিয়মকানুনই মানা হয়নি। মূলত অগ্রিম বিলের পুরো টাকাই ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা যোগসাজশে ভাগ-বাঁটোয়ারা করেছেন। যদিও অগ্রিম বিলের পরিমাণ ছিল আরও বেশি। গত দেড় বছরে কাজ করিয়ে অগ্রিম বিলের পরিমাণ কিছুটা কমানো হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার পট পরিবর্তে বেশির ভাগ ঠিকাদার পলাতক।

তিনি আরও বলেন, ২০২১-২০২২ এবং ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে বেশির ভাগ অগ্রিম বিল দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় একাধিক তদন্তও করেছে। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ‘অদৃশ্য’ কারণে তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নজরুল হাকিম-এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। বরং তাকে ১৩ জুলাই ২০২৩ তারিখে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশল পদে পদোন্নতি দিয়ে ময়মনসিংহ সার্কেলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. জালাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সিলেট জেলার বেশ কয়েকটি কাজে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এগুলো আমি দায়িত্ব গ্রহণের অনেক আগের। অনিয়মের বিষয়ে মন্ত্রণালয় তদন্ত করেছে, বিভাগীয় ভাবেও তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে বিধি মোতাবেক মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে।

ইইডি সিলেট অফিস সূত্র বলছে, শুধু বীরমঙ্গল উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণকাজ নয়, ইইডির সিলেট জেলা কার্যালয়ের অধীন অন্তত ৮০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজে ‘অবৈধ সুবিধার’ বিনিময়ে অগ্রিম বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এই তালিকায় রসময় উচ্চ বিদ্যালয়, আতাহারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, মুলাগুল হারিছ চৌধুরী একাডেমি, লালাবাজার আলিম মাদ্রাসা, শাহাজালাল বাজার উচ্চ বিদ্যালয়, আবদুর রাজ্জাক স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়, গোলাপগঞ্জ সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ প্রভৃতি রয়েছে।

সূত্র আরও বলছে, যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অগ্রিম বিল দেওয়া হয়েছে সেগুলোর বেশির ভাগের কাজ চলছে ঢিলেতালে। কোন কোনটির কাজ পুরোপুরি বন্ধ। কারণ ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর বেশির ভাগ ঠিকাদার আত্মগোপনে চলে গেছেন।

জানতে চাইলে ইইডির সিলেট জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুল আরেফিন খান বলেন, আমি কয়েক দিন আগে যোগদান করেছি। এসব কাজ হয়েছে ২০২২-২০২৩ সালে। এ বিষয়ে আমি কোন মন্তব্য করব না।

অগ্রিম বিল পরিশোধের সময় ইইডির সিলেট জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বে ছিলেন মো. নজরুল হাকিম। অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এখনো তো কাজে শেষ হয়নি। কিছু অগ্রিম বিল দেওয়া হয়েছিল সেগুলো সব রিকভার হয়ে গিয়েছে।

সম্পর্কিত বিষয়: