২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ , ৭ পৌষ ১৪৩১ 

বিদেশ

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের পুরোটায় আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

প্রকাশিত: ১৩:১১, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের পুরোটায় আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে

বাংলাদেশ-মিয়ানমারের প্রায় ২৭০ কিলোমিটার সীমানার পুরোটাই এখন আরাকান আর্মির দখলে বলে জানিয়েছে বিবিসি। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান যুদ্ধে দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।

জান্তার শেষ অবশিষ্ট সীমান্ত ঘাঁটি মংডু শহরের বাইরে অবস্থিত বিজিপি৫ ব্যাটালিয়নও গত কয়েক মাসের টানা লড়াইয়ের পর রোববার তারা দখলে নিয়েছে।

ঘাঁটি ঘেরাও করে রাখা আরাকান আর্মির ভিডিওতে দেখা যায়, তাদের যোদ্ধারা ঘাঁটিতে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র থেকে গুলি ছুড়ছে। পাশাপাশি বিমান বাহিনীও হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।

২০২১ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলছে দেশটিতে। প্রায় আট মাসেরও বেশ সময় ধরে দেশটির জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে আরাকান আর্মি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারের চলমান এই যুদ্ধে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা সহযোগী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি-এআরএ এবং আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসাসহ কয়েকটি সংগঠনের অবস্থান ছিল জান্তা বাহিনীর পক্ষে।

সামরিক অভ্যুত্থানের নেতা জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের জন্য এটি আরেকটি লজ্জাজনক পরাজয়।

সেনাবাহিনী চলতি বছরের শুরু থেকেই আরাকান আর্মির কাছে একের পর এক শহর হারাচ্ছে। শেষ সেনা ইউনিটগুলো সেপ্টেম্বরে বিজিপিকে (বর্ডার গার্ড পুলিশ ৫) প্রত্যাহার করে নেয়। এটি ছিল মংডুর সীমান্ত শহরের ঠিক বাইরে প্রায় ২০ হেক্টরজুড়ে একটি কম্পাউন্ড।

বিজিপি৫ মুসলিম রোহিঙ্গা গ্রামের মায়ো থু গি-র জায়গায় নির্মিত হয়েছিল। ২০১৭ সালে সশস্ত্র বাহিনী গ্রামের রোহিঙ্গা জনসংখ্যার বেশিরভাগকে বিতাড়িত করার সময় পুড়িয়ে দিয়েছিল।
জুনে শুরু হওয়া মংডুতে লড়াইয়ের তীব্রতা বিচার করলে ধারণা করা যায়, দেশটি তাদের শত শত সেনা হারিয়েছে।

গত ৭ ডিসেম্বর আরাকান আর্মির তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছে, রাখাইনের আন অঞ্চলের ৩০টিরও বেশি জান্তা বাহিনীর ক্যাম্প তারা দখল করে নিয়েছে। এসময় সামরিক বিমান ও সামরিক হামলা প্রতিহত করে পাল্টা জবাবও দিচ্ছে তারা।

এর আগে, মংডুতে মিয়ানমারের সেনারা শনিবার থেকে আত্মসমর্পণ শুরু করে। আরাকান আর্মির ভিডিওতে দেখা যায়, সাদা কাপড় নাড়তে নাড়তে করুণ অবস্থায় বেরিয়ে আসছেন সেনারা। কেউ কেউ ক্রাচে ভর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, বা ন্যাকড়ায় মোড়ানো আহত পায়ে হেঁটে বের হচ্ছেন। খুব কম লোকের পায়েই জুতো ছিল।

বিধ্বস্ত ভবনের ভেতরে বিজয়ী বিদ্রোহীরা লাশের স্তূপের ভিডিও ধারণ করে।

আরাকান আর্মি বলছে, মংড়ু অবরোধের সময় ৪৫০ জনেরও বেশি সেনা নিহত হয়েছে। এতে আটক কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থুরিন তুন ও তার কর্মকর্তাদের ফ্ল্যাগপোলের নিচে হাঁটু গেড়ে বসে বিদ্রোহীদের ব্যানার উড়ানোর ছবি প্রকাশ করা হয়েছে।

এদিকে, মিয়ানমারের সামরিকপন্থী ভাষ্যকাররা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের হতাশা প্রকাশ করছেন।

বিজিপি-৫ দখলের ঘটনাও প্রমাণ করে আরাকান আর্মি মিয়ানমারের অন্যতম কার্যকর লড়াকু বাহিনী।

২০০৯ সালে মিয়ানমারের অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর তুলনায় অনেক পরে আরাকান আর্মি গঠিত হয়।

সম্প্রতি মংডু ছেড়ে বাংলাদেশে আসা এক রোহিঙ্গা বিবিসিকে বলেন, "মংডু ও আশপাশের গ্রামের ৮০ শতাংশ আবাসন ধ্বংস হয়ে গেছে।”

"শহর নির্জন। প্রায় সব দোকানপাট ও বাড়িঘরে লুটপাট চালানো হয়েছে।”

২০১৭ সালে সাত লাখ রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করার পরও রাখাইনে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আরাকান আর্মি কীভাবে আচরণ করবে তাও স্পষ্ট নয়।

সবচেয়ে বেশি মানুষ উত্তর রাখাইন রাজ্যে বাস করে। মংডু দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত শহর।

বিবিসি লিখেছে, আরাকান আর্মির সমর্থক সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগোষ্ঠী রাখাইনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে।

বাংলাদেশের বিশাল শরণার্থী শিবিরে অস্থান করা রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলো সেনাবাহিনীর পক্ষাবলম্বনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তারা এখন আরও খারাপ অবস্থায় আছে।

তুমুল লড়াইয়ের মুখে জান্তা বাহিনীর মিত্র হিসেবে পরিচিত আরাকান রোহিঙ্গা আর্মির রোহিঙ্গা মিলিশিয়া, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) বিরুদ্ধেও তারা হামলা চালিয়েছে। অব্যাহত হামলার মুখে তারাও ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়েছে।

এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে হামলার মুখে কয়েকটি রোহিঙ্গা সংগঠনের নেতারা অস্ত্রসহ বাংলাদেশে আশ্রয়ের পর তাদেরকে আটকও করেছিল পুলিশ।

সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হওয়া থেকে বিরত রাখতে চায়। এদিকে রাখাইনবাসীও মনে করে রাখাইন রাজ্যে কোনো রোহিঙ্গা থাকা উচিত নয়।

একজন রোহিঙ্গা বিবিসিকে বলেন, “সামরিক জান্তার শাসনামলে আমাদের অবস্থা যতটা কঠিন ছিল, আজ আমাদের অবস্থান তার চেয়েও বেশি কঠিন।”