২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ , ৭ পৌষ ১৪৩১ 

শিল্প ও সাহিত্য

ভ্রমণ গদ্য

ফিজিয়ানরা মাটির সাথে সম্পৃক্ত করে নিজেদের পুনরুত্থানে সচেষ্ট

শাঁওলী শহিদ

প্রকাশিত: ১৯:২১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪

ফিজিয়ানরা মাটির সাথে সম্পৃক্ত করে নিজেদের পুনরুত্থানে সচেষ্ট

আমার সকল খেলা, সব কাজে, 
           এ ভূমি জড়িত আছে শাশ্বতের যেন সে লিখন।
হঠাৎ চমক ভাঙে নিশীথে যখন
সপ্তর্ষির চিরন্তন দৃষ্টিতলে,
     ধ্যানে দেখি, কালের যাত্রীর দল চলে
                   যুগে যুগান্তরে।
                 এই ভূমিখণ্ড-'পরে
                   তারা এল, তারা গেল কত।
             তারাও আমারি মতো
                 এ মাটি নিয়েছে ঘেরি--
             জেনেছিল, একান্ত এ তাহাদেরি।
                                         রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমাদের দেশের কিংবা ভারতবর্ষের এতো সমৃদ্ধ সংস্কৃতি থাকবার পরেও আমরা এখনও কেনো এতোটা বিভ্রান্ত - হঠাৎ এই প্রশ্ন টা মনে জাগলো যখন ফিজিতে ছিলাম! প্রায় দুই সপ্তাহের ফিজি ট্যুরে প্রতি মুহূর্তে দেখছি ফিজিয়ান রা নিজেদের সংস্কৃতি, আচার, আচরণ কে কিভাবে রক্ষা করবার চেষ্টা করছে। ফিজি সর্ম্পকে খুব জানা ছিলো না! এবারের ভ্রমণ টা একটু ভিন্ন কারণ দুই দেশের আদবাসীদের মিলনমেলা ছিলো এটি। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী ছাত্রীদের নিয়ে এসেছিলাম এঁদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানবার জন্য। ইতিহাস থেকে শুরু করে অর্থনীতি, আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো, অবস্থা, সংস্কৃতি সম্পর্কে একরকম হাতেখড়ি হলো বলা যায়। এই প্রথম কোনো জায়গা থেকে ফেরার সময় মনে হলো থেকে যাওয়া যেতো যদি! যা হোক! সে বিষয়ে পরে লিখবো ক্ষণ!


ফিজিয়ান আদিবাসীদের ব্যবহার দেখলে অবাক হতে হয়। আবালবৃদ্ধবনিতা এঁরা এতোটা নম্র, ভদ্র, মাটির মানুষ! অদ্ভুতভাবে যখন যা প্রশ্ন মনে এসেছে অকপটে উত্তর করেছেন যখন যাঁর সাথে কথা বলেছি আমরা। খুব অবাক হলাম জেনে যে এরকম মানুষগুলোর পূর্বপুরুষেরা নৃশংস ছিলো। ক্যানিব্যালিজম এর অভ্যেস ছিলো ওদের। তার চাইতেও অবাক হলাম দেখে যে এ সম্পর্কে এঁরা কথা বললেন নিঃসংকোচে। বঙ্গদেশীয় আমরা তো এতোটাই কুপমন্ডুক, মূর্খ যে অতীতের ভুল ঢাকতে, ঢাকতে আমরা অতীতকেই অস্বীকার করে ফেলি, অতীত বা ইতিহাস থেকে শেখা তো দূরের কথা। শিখতে গেলে প্রথম যে শর্ত তা হলো আত্ম-প্রতিফলন বা self-reflection অথবা self-actualisation বলা হয় highest form of knowledge. তো ফিজিয়ানরা সেই কাজটি করেছিলেন যখন ব্রিটিশরা এখানে তাদের ঘাঁটি গড়তে এসেছিলো। 


অস্ট্রেলিয়াতে থাকতে, থাকতে ঔপনিবেশিকতা সর্ম্পকে এমন একটা নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠেছে ভেতরে, ভেতরে বুঝতে পারলাম (ভাববেন না যে তার খুব একটা ব্যত্যয় ঘটেছে কারণ ঔপনিবেশিকতার রকমফের ঘটেছে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে। ঔপনিবেশিকদের উদ্দেশ্য অনুযায়ী এবং আরও নানাবিধ কারণের সংমিশ্রণে। আর আজকে যে আমরা পরোক্ষভাবে ঔপবিবেশিকতার শিকার হচ্ছি তা সম্পর্কেই বা আমরা কতজন ওয়াকিবহাল!) যাক! আজকের লেখা ফিজি নিয়ে! যখন ফিজিয়ানরা ব্রিটিশদের কে ধন্যবাদ দিল তাদের দেশের অবস্থার জন্য! প্রথমদিন নিজেদের কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি। মনে একগাদা প্রশ্ন নিয়ে বাড়ী ফিরে চিন্তার ঘোর কাটে না! পরের দিন সাহস করে জিজ্ঞেস করাতে বেরিয়ে গেলো যে সত্যিই ঔপনিবেশিকতা ফিজিয়ানদের জীবনে নিয়ে এসেছে বিপুল পরিমাণ ইতিবাচক পরিবর্তন। কিন্তু যারা পড়ছেন ভেবে বসবেন না ব্রিটিশরা যেচে এসে এঁদের উপকার করেছে! 


ফিজিয়ানরা নিজেদের অতীতের কথা ভেবে, নিজেদেরকে শোধরাবার জন্য ব্রিটিশদের কাছে প্রথমেই আত্মসমর্পণ করেছিল। তাঁরা ব্রিটিশদের অতিথি হিসেবে দেখেছিলো এবং  সাদরে গ্রহণ করেছিল।কিন্তু তাঁদের সাথে এমন এক মেমোরেন্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং এ এসেছিল (এখানে তাঁদের দূরদর্শিতা দেখে আমি অবাক হয়েছি) যেনো ভবিষ্যতে তাঁরা নিজেদের ঐতিহ্য ও অটুট রাখতে পারে আবার ব্রিটিশদেরও মন রক্ষা হয়।  তাই ব্রিটিশদের এঁরা এ দেশ শাসন করতে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু তারা নিজেরা তাদের সংস্কৃতির ওপরে, ভূমির ওপরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারাতে দেয়নি। তার সবচাইতে বড় উদাহরণ হলো ফিজিয়ানদের land management system. ফিজির ৯১ শতাংশ ভূমি ইটোকেইদের ভূমি । সবচাইতে আশ্চর্যের বিষয় ফিজিয়ানরা কেউ কিন্তু জমির মালিক নয় কিন্তু সবার জমি রয়েছে। ভাবতে পারেন বাংলাদেশে যেখানে কিছু মানুষের জমি, বাড়ী-ঘর, সম্পত্তির হিসেব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সেখানে আদিবাসী ফিজিয়ানদের নিজেদের জমি নেই! কারণটা পরে লিখছি। 


ফিজিয়ানরা নিজেদের সংস্কৃতি, সভ্যতাকে পশ্চিমা ছোবল মুক্ত রাখবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন। দেখলে সমীহ জাগে। এখানে গ্রাম প্রচুর। এখনও গ্রামের মোড়ল ব্যবস্থা (যাঁকে ওঁরা বলে চিফ) প্রচলিত কিন্তু ফিজিয়ানরা প্রতিনিয়ত এর আধুনিকায়ন করার চেষ্টা করে চলেছেন। সময়ের সাথে, সাথে। গ্রামে এখনও barter system এর প্রচলন রয়েছে! কেউ যেনো অভুক্ত না থাকে। ফিজিয়ান আদিবাসী অধ্যুষিত কয়েকটা স্কুলে গেলাম।boarding স্কুল। খাবার দাবারে স্বয়ংসম্পূর্ণ তারা। নিজেদের মাটির উপযুক্ত ফসল, ফলফলান্তি নিজেরাই উৎপাদন করছে তাঁরা সেখানে। ছাত্রদেরকেও কৃষিকাজে হাত লাগাতে উৎসাহ দিচ্ছে। এতে তাঁদের হাত ক্ষয়ে যাচ্ছে না বরং মস্তিষ্ক হচ্ছে উর্বর! কীভাবে পরে লিখবো।


যাহোক! যা বলছিলাম! জমি বণ্টন ব্যবস্থা! ১৯৪০ সালে ফিজিয়ানরা স্থাপন করে iTaukei Land Trust Act and Agricultural Landlord & Tenant Act. যেখানে বলা হয়, “iTaukei land cannot be sold.” কারণ তা তাদের মূল্যবোধের বিরোধী। ফিজিয়ানরা জমির ব্যক্তিগত মালিকানায় বিশ্বাসী নয়। অস্ট্রেলিয়াতেও Aboriginal দের ভেতরে private ownership of land বলে কিছু ছিলো না। এগুলো পশ্চিমাদের পরম অবদান। বড়, বড় দেশের বড়, বড় জ্ঞান-গরিমা। ? বরং আদিবাসীদের জীবনের প্রধান ভিত্তি  হলো সম্পর্ক, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সমতা, নিজেদের ভেতরে এবং প্রকৃতির সাথে আদান-প্রদানের মাধ্যমে বেঁচে থাকা। ভূমি বা ল্যান্ড আদিবাসীদের জীবনে পবিত্র বন্ধন। ভূমির সাথেই তাঁদের আত্মার সম্পর্ক। ভূমি তাঁদের ভাষা বোঝে, তাঁদের কথা শোনে, তাঁদের পথ দেখায়। আমাদের দেশও তো আমাদের কাছে তাই, না? দেশমাতৃকাকে আমরা পুজো করি। করতাম বলাই বোধহয় ঠিক হবে। তাই তো পৃথিবীর যে প্রান্তেই আমরা বসবাস করি না কেনো আজও বাংলা শুনলে আমাদের মন হয় উচাটন। বাঙালীর জয়যাত্রা দেখলে আশায় মন বাঁধে! কিন্তু সে কোন বাংলা? এ প্রশ্নের উত্তর আমি দেবো না। আপনাদেরকে ভাবতে বলবো। 
ইটোকেইদের মূলনীতি এর ওপরে ভর করে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে ভূমিকে ব্যক্তিমালিকানাধীন করা চলবে না। ইটোকেই রা ৯৯ বছরের জন্য ল্যান্ড ট্রাস্টের কাছ থেকে জমি ধার করেন, তারপর কেউ সেখানে বাড়ী বানান কিংবা ব্যবসা বাণিজ্য করেন। ল্যান্ড ট্রাস্টকে তাঁরা ভাড়া দেন। ল্যান্ড ট্রাস্ট কিন্তু এগুলো নিজেদের পকেটে পুরে ফেলেন না! ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এর কিছু অংশ তাঁরা জমা করেন এবং পরবর্তী প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা যখন ১৮ বছর বয়সী হয় তখন এই অর্থটা তাঁরা তাঁদেরকে দেন যেনো নতুন প্রজন্ম তাঁদের ভবিষ্যৎ গড়ে নিতে পারে। 


এখন আবার ফিরে যাই অতীতে। উপনিবেশের শুরুতে! ব্রিটিশরা কীভাবে, কেনো মেনে নিয়েছিলো এঁদের এই ব্যবস্থা! তারা তো দ্বীপদখলের উন্মত্ততায়ই ফিজিতে এসেছিলো! তাহলে ইটোকেইরা কি করে তাদের সাথে বোঝাপড়ায় এলো? সেখানেও ইটোকেই দের দূরদর্শিতাই বলবো আমি এবং আত্মসচেতনতা। 
আগেই বলেছি ইটোকেইরা খুব অতিথিপরায়ণ। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে তাঁদের জমির এক ক্ষুদ্র অংশ তারা ব্রিটিশ সহ অন্যান্য অতিথিদের দিয়ে দেবে। বিনিময়ে তাঁরা নিজেদের সংস্কৃতির আদলে দেশ গড়ে তুলবে।  তারপর Ratu Sir Lala Sukuna কে পাঠিয়ে দিয়েছিলো Oxford University তে পড়তে কিন্তু উনি পশ্চিমা শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হয়ে এসেও এমনভাবে ফিজির জমিব্যবস্থা কে সংস্কার করেছিলেন যে এতে ফিজিয়ানদের শাপে বর ই হয়েছে। এখনও ফিজিতে তিন ধরনের জমি আছে:
১. ইটোকেই ল্যান্ড- ৯১%
২. ফ্রীহোল্ড ল্যান্ড - ৭% এবং
৩. রাষ্ট্রীয় ল্যান্ড - ২%
আপনাদের যদি উন্নতির মাপকাঠি হয় GDP! কিংবা বাড়ী, গাড়ী, চাকরী, বেতন তো মনে হবে এঁরা হতদরিদ্র কিন্তু তারা নিজেদেরকে সুখী দাবী করছে। মিতভাষী, হামবরামী নাই কারও মধ্যে। গ্রামের মানুষগুলো মাটির সাদাসিধা মানুষ কিন্তু তাঁদের আদর আপ্যায়নের সীমা নেই। 


আমরা একটা বোট ট্যুরে গিয়েছিলাম। এই প্রকল্পটার নাম হলো Uto Ni Yalo. এর অর্থ হলো Heart of the Spirit. এই প্রকল্পের আওতায় ফিজিয়ান তাঁদের ঐতিহ্যবাহী যে প্র্যাক্টিস ছিলো যা ওদের ভূমির উপযুক্ত এবং ঐতিহ্য বহন করে তাকে ওরা আধুনিকায়ন করার চেষ্টা করছে। ২০১০ সালে ওরা একটি বজরার মতো বড় নৌকা বানায়। ওই প্রজেক্টের মূল বৈশিষ্ট্য গুলো দেখলে বোঝা যায় যে সেগুলো কতোটা নিজেদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতিকে ভর করে গড়ে ওঠা। সেগুলো হলো: 
- love for their ocean
- wisdom of our traditional knowledge 
- collaboration 
- their wellbeing
এই নৌকাতে আধুনিক দিক নির্ধারক কোন  যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় নি। দিকনির্দেশনা হয় wayfinding করে which is the art of navigation using the natural elements, such as, stars, sea swell, currents and waves cloud formations, bird life এগুলো দিয়ে। সাথে, সাথে এঁরা canoe building এরও প্রজেক্ট করছে যেনো তরুণ প্রজন্মের ভেতরে এই জ্ঞানের সম্প্রসারণ ঘটে এবং সাথে, সাথে কর্ম সংস্থানেরও সুযোগ তৈরী হয়।
Turtles বা কচ্ছপ হলো ওঁদের লোগো। কারণ? Turtles are the best navigator in the animal kingdom. Female turtles can come back home to lay their eggs from anywhere in the globe. 
এই নৌকা নিয়ে এঁরা একমাসের ওপরে ট্যুরও করে এসেছে। ফিজি থেকে আমেরিকাও ঘুরে এসেছে। 
এভাবেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ফিজিয়ানরা নিজেদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, তাঁদের নিজেদের মাটির সাথে সম্পৃক্ত করে পুনরুত্থান করায় সচেষ্ট। বাঙালী! কিছু শিখুন! নিজেকে একটু জানবার চেষ্টা করুন।