এ্যাই শোননা রুমা ফুপুর গল্পটা।
: রুমা ফুপু তো তোমার নিজের কেউ না।
: ছোটবেলা থেকে ফুপু ডাকছি, তাদের হাত ধরে তাদের সাথে স্কুলে গিয়েছি। এখানে আপন পর গল্প আসছে কেন?
: না এমনি বললাম আর কি?
: এমনি মানে কি? শুনতে চাও না বললেই হত। আমার অসম্ভব রাগ হতে লাগল।
: আচ্ছা বলো, বলো শুনছি।
: থাক আর শুনতে হবে না। এমন বলতে বলতে আমরা মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের কাছে চলে এসেছি। এখানে এসেই তার কি মনে হলো গাড়িটা রাস্তার সাইডে পার্ক করে বলল, ’চল বাজারে যাই’।
: বাজারে কেন? কি কিনবা? তোমাকে তো কিছু কেনার লিস্ট দেই নাই।
: সবসময় কি লিস্ট ধরে কিনি আমরা? চল মাছ দেখি! চল মাছ দেখব।
: এখন মাছ কেনার দরকার কি?
: তুমি ইন্টারেস্টেড না? কেন যাবা না? আরেহ চলো যাই।
নাহ। বলে আমি গাড়িতেই গ্যাট হয়ে বসে থাকলাম। আমার ধারণা আমাকে আরো রাগাতেই সে অকারণ বাজারে নেমে গেল। আমি আর কি করব, মোবাইল ঘাটতে লাগলাম। যদিও নেটহীন মোবাইল কতক্ষণ ঘাটা যায়! তাই আশেপাশে তাকাতেই দেখি ঝুমা আপা বাজারের ব্যাগ হাতে ফুটপাতে উঠল। ঝুমা আপা! সেই কবে দেখেছি, ভুল হতে পারে তবুও আমি দ্রুত গাড়ি থেকে বের হয়ে তাকে ধাওয়া করলাম। একরকম দৌঁড়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললাম ঝুমা আপা! কেমন আছেন? আপা চমকে গেলেন। তারপর অবাক চোখে চেয়ে বললেন,’ চিনতে পারছি না যে!’
আমি একটু লজ্জা পেলাম। সত্যিই তো আপা আমায় চিনবে কেমন করে? স্কুলে তো আমি বিশেষ কেউ ছিলাম না। আর আপার বাসায় গিয়েছিলাম একদিন সেও তো কতযুগ আগে আপার এক বান্ধবীর সাথে। আমার ঝুমা আপার প্রতি আগ্রহ ছিল তাই মনে রেখেছি, আপার তো মনে নাই। তাছাড়াও আপার এমন ভক্ত ফ্যানের কি অভাব আছে, না ছিল যে আমায় মনে রাখবে?
তবু আপাকে আমার নাম বললাম । আপা আমি আপনার বান্ধবী কনার কাজিন। আপনি আমাদের স্কুলের সিনিয়র আপা। উনি ভাবলেশহীনভাবে বললেন তাই!
: আপনি এদিকে কোথায় থাকেন আপা ? কবে আসলেন ঢাকায়? বাচ্চাদের ভর্তি করেছেন এদিকে? মুহূর্তে যেন তার মুখের আলোটুকু নিভে গেল। পরমুহূর্তেই সামলে নিয়ে বললেন, আরে না ওদের ভর্তি করিনি। আমি থাকি এদিকে। বলতে বলতে যেন কিছুটা আড়ষ্ট হলেন। আমিও যেন একটু থতমত খেয়ে গেলাম। আর প্রশ্ন করলাম না। উনি আর কিছু না বলে হাঁটা শুরু করলেন। ভাবলাম উনার হয়ত তাড়া আছে, তাই সাথে সাথে বললাম আপা মোবাইল নাম্বারটা?
ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘মুখস্ত নাইরে’। একটা মলিন হাসি দিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলেন।
আমি হতভম্ব হয়ে ফিরে আসলাম গাড়িতে। মনটা একটু খারাপ হলো নাম্বার চেয়ে না পাওয়ার ব্যর্থতায়। কি আর করা আমার মন মুভিতে দেখতে লাগলাম ঝুমার আপার স্কুলবেলা সংসার বেলা।
ঝুমা আপা আমার চেয়ে চার ক্লাস উপরে পড়ে। আমরা যখন ক্লাস সিক্সে ভর্তি হই আপা তখন ক্লাস টেনে। রুপকথার রাজকন্যার মত সুন্দর ঝুমা আপা। সুন্দরীরা হাসলে সত্যিই যে মুক্তা ঝরে ঝুমা আপা যেন তার চাক্ষুস প্রমান। আপা মাঝারি হাইটের আর হাঁটার ছন্দটাও কি চমৎকার। সে যেখানে দাঁড়ায় তার চারপাশ যেন আলো হয়ে যায়। এখনকার হিন্দি মুভির কঙ্কনা রানাউতের মত চোখ ধাঁধানো রাজকীয় সুন্দর। সকালের এসেম্বলীতে আপাই নিয়মিত শপথ পাঠ করাতেন। আমরা মন্ত্র মুগ্ধের মত তার সাথে শপথ পাঠ করতাম। তিনি যেন আমাদের আইডল। স্কুল ফাইনালের আগে দিয়ে শুনা গেল ঝুমা আপা পালিয়ে বিয়ে করেছেন এক বিহারী ছেলেকে। উনি আর টেস্ট পরীক্ষা দিলেন না। এমন কি ফেয়ারওয়েলএর দিনেও আসলেন না। আপাকে আর দেখিনি।
রুপকথার গল্পের সমাপ্তির মত অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল।
আমি তখন এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে অবসরে খালাদের বাড়িতে ঘুরছি। আমি আসা উপলক্ষ্যে খালাতো বোন কনাও তার ইউনির্ভাসিটি থেকে বাড়িতে এসেছে। এমন একদিন বিকালে কনা আপা বলল, চলো আমার সাথে।
: কোথায়?
: আমার এক বান্ধবীর বাড়িতে। আমার বান্ধবীটা খুব গুনবতী রুপবতীও। তুমি চেনো তাকে। আমাদের স্কুলে পড়ত। ঝুমা রে, চিনো নাই? সেই যে, সে এসেম্বলীতে নিয়মিত শপথ পাঠ করত।
: হুম হুম চিনেছি। পরমা সুন্দরী ঝুমা। আমরা শহরের যে প্রান্তে থাকি সেটা অনেকটা গ্রামীন এলাকার মত। যদিও কোতয়ালী থানার অধীন আর ঝুমাদের বাড়ি শহরের অন্য প্রান্তে যেটাকে মেইন টাউন বলে। আপা আবার ঝুমা গল্পে ফিরে গেল। আমি বাধ্য শ্রোতার মত শুনছি।
সে আমার জন্য একটা জামা বানিয়েছে। সেই জামায় চুমকি পুঁথি আর সুতার কাজও করেছে । আজকে গেলে সে মাপ নিয়ে ফাইনাল ফিটিং করে দিবে। জানো না তো সে যে কত গুনের। রাজ্যের সেলাই জানে। সেটা এমব্রডারী বলো, কুরুশ কাটা কিংবা উলের কাজ। কেউ তাকে হারাতে পারবে না। সে একেকটা ডিজাইন তোলে আর সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার কাছে ডিজাইন শেখার জন্য। এত চটপটে এত স্মার্ট অথচ পড়াশুনাটা করল না। সে যে আক্তারের সাথে প্রেম করত এটা আমরা কেউই মানে, যারা ঘনিষ্ট ছিলাম তারাও টের পাইনি। সে কাউকেই জানায়নি।
কাউকে না জানিয়ে পালিয়ে আক্তারকে বিয়ে করাটা তার বাবা মেনে নিতেই পারেনি। তারা তিন ভাই বোন সে বড় আর ছোট দু ভাই স্কুল পড়ুয়া। না আক্তার খারাপ ছেলে তা না। দেখতে চমৎকার। লম্বা ফর্সা হ্যাংলা চেহারা। ঘোলাটে চোখের অধিকারী। তাদের একই পাড়ায় বাড়ি। শহরের সেরা তিন আবাসিক হোটেলের মধ্যে তাদের একটা। দোতালা বাড়িটা যে কি রাজকীয় দেখলেই বুঝবা। প্রায় দশবিঘা জমির উপর তাদের বাড়িটা। বাড়ির পিছনে ফলের বাগান। সেই বাগানে দেশী বিদেশী কত ফলের গাছ আছে সে বাগানে, পিচ ফলের গাছও আছে জানো।
কিন্তু ঝুমার বাবার মেনে না নেয়ার কারণ হলো আক্তাররা নন বেঙ্গলী। তারা বিহারী। আর ঝুমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা। এছাড়াও আক্তার মেট্রিক পাশ করে আর পড়েনি। ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ঝুমা ছাত্রী ভালো তার বাবার ইচ্ছা ছিল মেয়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে। তা না সে পড়া বাদ দিয়ে পালিয়ে বিয়ে করল আক্তারের মত এক আনপড় পয়সাওয়ালা ছেলেকে। ঝুমা এমন ছেলেকে বিয়ে করার শোকে তিনি বাপদাদার ভিটা বিক্রি করে গ্রামে চলে গেছেন। যেন এজীবনে মেয়ের মুখ দেখতে না হয়।
অথচ দেখো এই দেশে আক্তরেরও কিন্তু কেউ নাই। যুদ্ধের সময় তার বেশীরভাগ আত্মিয় চলে গেছে পাকিস্তানে আর শুধু তার বাবা চাচারা এদেশেই ছিল ব্যবসা বানিজ্য ফেলে যায়নি কোথাও। তারা যুদ্ধের শুরুর দিকেই মারা পড়ে। তার বাবার ধান চালের আড়তও ছিল সেই আড়তে মুক্তিবাহিনীর লোকেরা একসাথে সাতজনকে মেরে ফেলে। দোকানের কর্মচারী মতিনই নাকি ইনর্ফমারের কাজ করেছিল। মতিন ভেবেছিল বিহারী তাড়িয়ে সেই দখল করবে গদী ঘর। কিন্তু মে জুনের দিকে যখন শহরের পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করে। তখন চোরাগোপ্তা হামলা শুরু হয়। সেসময় মতিনও মারা যায়। গদী ঘরে তার লাশ পড়ে ছিল দুই তিনদিন ধরে। গন্ধ ছড়ালে লোকজন বন্ধ গদীঘর থেকে মতিনের লাশ উদ্ধার করে। আর বাকি যে সব নিকট আত্মিয় ছিল তাদের কিছু যুদ্ধের শুরুতেই মারা পড়েছে কিছু স্বাধীন হওয়ার পরে। আক্তারের বারো কি তেরো বছর বয়স। সে ভালো বাংলা বলতে পারত। তার বাবা চাচা খুন হওয়ার দিন সন্ধ্যায় একদল বাঙ্গালী ইন্ডিয়ায় পালিয়ে যাচ্ছিল সে সেই দলের সাথে সে ভিড়ে যায়। ওপারের শরর্ণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। এভাবে আক্তার বেঁচে গিয়েছিল। যদিও তখন সে কিশোর।
এমন ঝুমা গাঁথা গাইতে গাইতে আমরা শেষ বিকালে পৌঁছালাম ঝুমার প্রাসাদে। সত্যি চমৎকার একটা দোতালা বাড়ি। যেমন বিশাল ভেবেছিলাম তেমন নয়, ছোটখাট দোতালা। উপর নীচ মিলিয়ে বোধহয় ছয়/সাতটা রুম। দোতালার প্রতিটি রুমের সাথে সামনে পিছনে বারান্দা আর প্রতিটি বারান্দাই ফুলের টবে সাজানো। টবগুলো ফুলে ফুলে রংগিন হয়ে আছে। সেসময় বারান্দা বাগানের এমন প্রচলন ছিল না। তাদের সেই বাড়িটা ছিল লাল ইটের রং করা। সেসময় এমন লাল ইট রংয়ের বাড়ি আর দেখেছি বলেও মনে হয়না। মোজাইকের সিড়ি বেয়ে উপরে উঠেই দেখি একজন বয়স্ক মহিলা, চেহারায় মায়ের মত দেখতে মনে হলো। কোথায় যেন ঝুমা আপার সাথে মিল আছে বোধহয় হাসিতে কিন্তু গায়ের রং কিংবা চেহারায় একটুও মিল নেই। কনা আপা সালাম দিল উনাকে। উনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন ঝুমা তার ঘরেই আছে যাও। আমরা যাওয়ার আগেই ঝুমা আপা বের হয়ে আসল। তারা দুই বান্ধবী জড়াজড়ি করল। তারপর তাদের গল্প শেষ হয়না। গল্পের ফাঁকে কনা জানতে চাইল, আন্টিকে দেখলাম, আর আংকেল?
ঝুমা আপা বললেন, ‘জানিসই তো বাবা রাগ করে সব বেচে গ্রামে চলে গেলে সেখানে ব্যবসা বানিজ্য করে সুবিধা করতে পারছিল না। আর্থিক অনটনে তার শরির খারাপ হতে লাগল। কিন্তু মেয়ের প্রতি রাগ আর পড়ে না। বছরখানেক পর হঠাৎ স্ট্রোক করলে আমি আর আক্তার যেয়ে তাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে আসি এখানে। আক্তার কেঁদে কেটে বাবাকে বলে যে, আমিও তো সবাইকে হারিয়েছি। আমার কি দোষ ছিল বলেন? আমি তো মরে যেতেও পারতাম। বেঁচে আছি আল্লাহর অসীম কুদরতে। আমার কি দোষ! আমি তো এদেশেরই সন্তান। আমি তো সুযোগ থাকা সত্বেও দেশ ছাড়িনি। আমার পূর্ব পুরুষের দোষে আমি কেন দোষী হব? এমন সব নানান কথা বলে বাবাকে কনভিন্স করে এখানে নিয়ে আসি। আসলে মানুষের জীবনে টাকা পয়সার জোর মস্ত জোর। বাবা তার আর্থিক দৈন্যতার সাথে সাথে মনের জোরও হারিয়ে ফেলেছিল। বাবা মা ভাইয়েরা সহ সবাই এ বাসাতেই উঠেছিল। বাবার চিকিৎসারও কোন ত্রুটি করা হয়নি। বছর দুয়েক মিলেমিশে ভালোই ছিলাম। তারপর মাস ছয়েক আগে বাবা হার্ট এটাকে মারা যায়। তারপর হঠাৎ মনে পড়াতে যেন বললেন, ’শোন পাপ্পু, মানে আমার পরের ভাইটা রাজশাহী ইউনির্ভাসিটিতে পড়ছে। তোর সাথে কি যোগাযোগ করেছিল? দেখা করতে গিয়েছিল? আমি তো তোর কথা বলেছি ওকে’।
কনা আপা বলল ঠিক আছে আমিই খুঁজে বের করব তাকে। তার সাবজেক্ট আর হলের নাম দিস। আমরা পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। তার কুরুশকাটায় তৈরী করা পুতুল দেখলাম। টবের গাছগুলো ফুলগুলোর নাম জানলাম। কাজিন জামার মাপ দিল ঝুমা চমৎকার করে ফিটিং করে দিয়ে পড়তে বলল। এত্ত সুন্দর হয়েছে যে আমিও আমার জামায় এমন একটা ডিজাইন করব বলে মনে মনে ঠিক করলাম।
তাদের কাজের লোক ট্রে ভরে নাস্তা নিয়ে আসল। সেখান থেকে একটা মিষ্টি তুলে আমাদের প্লেটে দিতে দিতে বলল যে সে এই মিষ্টিটা নিজে বানিয়েছে। তার কাজকর্ম আর প্রাসাদ দেখে আমি তো ফিদা। আহা যেমন রাজকুমারীর মত চেহারা তেমন তার রাজ কপাল। মনে মনে একটা সুক্ষ্ম হাহাকার বোধ জেগে উঠছিল তখন। আহা শুধু চেহারার জোরে আজ সে মহারাণী। মনে মনে ভাবলাম,আমার মত এই ফকিন্নি মার্কা চেহারার তো আর রাজপ্রাসাদ আর রাজপুত্র কিছুই জুটবেনা তাই পড়ে টড়ে নিজে কামাই করে নিজে খেতে হবে। আমরা এশার আযানের সময় বেরিয়ে আসলাম তার প্রাসাদ থেকে। ওনার বাড়ি থেকে বের হয়েই কেন জানিনা এই প্রবাদটা আমার মনে হলো; যে নারীর কোন গুন নাই তার কপালে আগুন আর যে নারীর কোন গুন বাদ নাই তার কপালেও আগুন। আবার মনে মনে নিজেই বললাম ধুর কি সব ভাবছি। যাই ভাবিনা কেন ঝুমা আপা কিন্তু আমায় মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করে রাখল। আর কোনদিন যাওয়া হয়নি তার বাসায় দেখাও হয়নি। কিন্তু মনের গহিনে তার ছবিটা আঁকা হয়েছিল।
কনা আপার সাথে দেখা হলে অতি অবশ্যই ঝুমার প্রসঙ্গ উঠত। শুনেছি তার এক ছেলে আর এক মেয়ে হয়েছে। এরপর দীর্ঘদিন আমার সেই কাজিন কনা আপার সাথে দেখা হয়নি। না ভুল বলছি দেখা হয়েছিল তার বাড়িতে একবার সদলবলে (আরো অন্যান্য কাজিনরা সহ) বেড়াতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই ভিড়ে অবসর হয়নি ঝুমা প্রসঙ্গ আলাপের। ঝুমা আপার ছায়া রাস্তার বাঁকে মিলিয়ে যাওয়ার পর কনা আপাকে কল দিলাম। বললাম যে এইমাত্র ঝুমা আপার সাথে দেখা হলো। উনি ঢাকায় থাকে জানেন?
ঃ জানি । সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো ঝুমার বিয়ের দশ বছরের মাথায় আক্তারও হার্ট এটাকে মারা যায়। তখন ঝুমার ছেলের বয়স ছয় আর মেয়ের বয়স তিন। সে ছেলের নাম রেখেছে রৌদ্র আর মেয়ের নাম রেখেছে রংধনু। কি সুন্দর ফুটফুটে হয়েছে যে বাচ্চাগুলো। সে সময় সে আক্তরের সব ব্যবসা আর ব্যাংক ব্যালান্স নিয়ে সে কিছুটা স্বেচ্ছাচার হয়ে উঠে বোধহয়। তার মাও মারা গেছেন আক্তার মারা যাওয়ার দু’বছর পর। ভাইয়েরা আপন আপন সংসার চাকুরী নিয়ে বিজি। সে যেন আরো স্বাধীন হয়ে পড়ে। সৌন্দর্য আর অর্থে সে তখন যেন ডানা পেয়ে গেছে। আশেপাশে চাটুকার আর স্তুতিকারের ভীড় লেগে থাকত।
সেই ভীড়ের মধ্যে ফরিদও ছিল। সেই ফরিদ তখন কিসের যেন ব্যবসা করত। সে তার ব্যবসায় ঝুমাকে লগ্নি করার জন্য কিভাবে যে পটিয়েছে আল্লাহই জানে। সবাই অবাক হয় যখন শুনে যে, ঝুমা আবার বিয়ে করেছে তাদের পাড়ার সেই ফরিদকেই। ফরিদ আমাদেরই ইয়ারমেট। ঝুমা যে কি বুঝল আর ফরিদের মধ্যে কি দেখল সেটা একমাত্র সেই জানে, ফরিদ হলো খাটো আর ইয়া ভুড়িওয়ালা, নিন্দুকেরা তার নারী প্রীতির কথাও বলে। তার বউ বাচ্চা আছে জেনেও ঝুমা তাকেই বিয়ে করেছে। ফরিদও ব্যবসায়ী। ঝুমার প্রায় সব টাকাই সে তার ব্যবসায়ে লগ্নি করে। তার এত টাকা ইনভেস্ট করায় ফরিদের বউও ঝুমাকে বিয়ের ব্যাপারে কোন উচ্চবাচ্য করেনা,নিরব থাকে। কিন্তু ঝামেলা পাকায় ঝুমার নিজের ছেলেমেয়েরা। তারা তাদের মায়ের বিয়েতে মত দেয়না। বাচ্চাদের মতামত অগ্রাহ্য করে তাদের ফেলে রেখে সে বিয়ে করে ফরিদকে।
বিয়ের বছর খানেকের মধ্যে ফরিদ সপরিবারে ঢাকায় চলে গেলে ঝুমাও ঢাকায় সেটেল হতে চায় কিন্তু বাচ্চারা কিছুতেই ঢাকায় ফরিদের আন্ডারে থাকবে না বলে জিদ আঁকড়ে থাকে। ঝুমার ধারণা এই জিদের পিছনে ইন্ধন যোগায় আক্তারের এক নন মুসলিম বন্ধু রতন। রতনও পয়সাওয়ালা মানুষ তারও মিল চাটালের ব্যবসা আছে। আক্তার মারা যাওয়ার পর সেই রতনই আক্তারের সব ব্যবসা বানিজ্য শক্ত হাতে তদারকি করে। বাচ্চাদের স্কুল থেকে শুরু করে পার্কে নিয়ে যাওয়া মেলায় বেড়াতে যাওয়া পালা পার্বনে কেনা কাটা সবখানে সব আবদার রতনই পুরণ করত। বাচ্চারাও রতনের খুব ভক্ত। রতন কিন্তু ঝুমার বিয়ে করার ব্যাপারে বা ফরিদের সাথে ব্যবসায় টাকা লগ্নির ব্যাপারে কখনো কোন কথা বলেনি। কিন্তু ছেলেটার বয়স মাত্র তের বছর হলেও সে প্রতিবাদ করে মায়ের এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। শেষমেশ বাচ্চাদের সাথে জিদ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তারা তার মা’কে চলে যেতে বলে ফরিদের সাথে। ছেলেটা থাকে তাদের হোটেলে আর মেয়েটা থাকে রতনের বাড়িতে।
রতনের বউও খুব আন্তরিকতার সাথে বাচ্চাদের গ্রহণ করে। রতনরা ননমুসলিম হলেও আক্তারের বাচ্চাদের জন্য সব মুসলমানী রীতি পালন করে।
সময় তো গড়িয়ে যায় সময় কি আর থামে?
চন্দ্র সূর্যে গ্রহণ লাগে বৃষ্টি হয় জ্যোস্নাও নামে!
সুখের সময় দৌড়ে পালায় অশ্রুধারাও নামে।
এরপর কেটে গেছে আরো ৯/১০ বছর। খোঁজ নেয় হয়নি ঝুমার কিংবা কণার। সবাই যার যার ক্ষেত্রে সুখে আছে। কনা আপার ছেলে অষ্ট্রিলিয়া যাবে। আপা ঢাকায় এসেছেন। ছেলে বিদায়ের পর আপার খুব মন খারাপ। আমি অফিস ছুটি নিলাম আপার সাথে কাটাবো বলে। আবার ঝুমা আপা প্রসঙ্গ এলো। কেমন আছে ঝুমা আপা? ঢাকায় আছে তো? চলেন যাই দেখে আসি ঝুমার আপার ২য় সংসার।
আপা বলল আর ঝুমার সংসার! তোমাকে বলা হয়নি না? ও তো প্যারালাইজড হয়ে দিনাজপুরে ব্যাক করে। শরিরের ডান পাশটা পুরোপুরি সচল নয়। কথাও স্পষ্ট নয়। তার নিজের শরিরের এই বেহাল অবস্থায় সে পাগল প্রায়। ছেলে তো বিয়ে করেছে। দু’জন নাতী পূতিও হয়েছে এদিকে মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। রতন পাত্র এনেছে। প্রবাসী ছেলে। এমেরিকায় থাকে বিয়ে করে মেয়েকে নিয়ে যাবে। মায়ের এমন অবস্থায় মেয়ে তার বিয়ে নিয়ে দ্বিধায়। মায়ের সেবা করবে কে? লোক লস্করের অভাব নাই কিন্তু ঝুমা চায় সব আগের মত সব তার কন্ট্রোলে থাকবে। কথা তো স্পষ্ট করে বলতে পারেনা কিন্তু চিৎকার চেচাঁমেচিতে বাড়ি মাথায় তুলে। ঝুমার অনুপস্থিতিতে তার ছেলেমেয়েরা রতনের সহযোগিতায় তাদের অনেক জমিজমা বিক্রি করে দিয়েছে। এসব নিয়েও ছেলেমেয়েদের সাথে রতনের সাথে মনোমালিন্য। ছেলেমেয়েদের এক কথার জবাব তুমি এতদিন কই ছিলা? এসব নানান বিষয় নিয়ে মনকষ্টে সে আরো বেশী অসুস্থ হয়ে পড়ে। আপা একটু বিষন্ন হয়ে পড়ে, গল্পে যেন পজ দেয়। আমি সেই সুযোগে আপাকে বললাম, সেই গল্পটা শুনেছেন তো আপা?
ঃ কোন গল্পটা?
ঃ ফেসবুকে পড়েছিলাম- ঐ যে, পিঁপড়ার মন খারাপ। কারণ সে খরগোশের মতো লাফাতে পারেনা। খরগোশের মন খারাপ কারণ সে হরিণের মতো ছুটতে পারেনা। হরিণের মন খারাপ কারণ সে পাখির মতো উড়তে পারেনা। পাখির মন খারাপ কারণ সে উড়োজাহাজের মতো গতিময় হতে পারেনা। কিন্তু তারা কেউই বুঝতে পারেনা যে সবার গতি যেমন একরকম নয়। সবার গন্তব্যও এক জায়গায় নয়। মানুষ বস্তুগত অভাবের কারণে অভিযোগ করেনা তার অভিযোগের সাথে যোগ হয় অপ্রাপ্তির, অবুঝপনা, অনুযোগের। সে অভিযোগ করে কারণ সে দেখে অন্যদের যা আছে তার কাছে তা নেই। যে ভাড়া গাড়ি চড়ে। সে গাড়ীর মালিকের দিকে চেয়ে থাকে। যার গাড়ি আছে সে চেয়ে থাকে যার দুটো গাড়ি আছে। যার দামি গাড়ি আছে তার আফসোস- কবে তার একটা ইয়ট হবে। যার ইয়ট আছে তার অতৃপ্ত মনের হাহাকার কবে তার একটা প্রাইভেট জেট হবে। না পেয়েও তার হাহাকার। পেয়েও তার অনুযোগ । এই যে ঝুমা আপার কি ছিলনা? সবই ছিল। কিন্তু তার মনে হয় ভালোবাসা পাওয়া হলোনা। কিন্তু সেই ভালোবাসা তো নসিবে থাকতে হবে? আহা ভালোবাসা পেতে যেয়ে সব হারালো।অভাবের চেয়ে মানুষের তৃপ্ত হওয়ার অভাবই বড় অভাব। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই অভাব, এই অতৃপ্তি মানুষের কখনো শেষ হয়না।
ঃ হুম মন্দ বলোনি। শোন তারপরে – তার মেয়ে রংধনু খুব সেবা করছিল মায়ের। বলা যায় একমূহূর্ত মাকে কাছ ছাড়া করে না। মেয়ের বিয়ে নিয়ে মেয়েকে সবাই বোঝায় যে সেরকম হলে মা’কে সাথে করে বিদেশ নিয়ে যাবা। ঐসব দেশে আরো উন্নত চিকিৎসা সেবা আছে ভালো হয়ে যেতেও পারে। আর ভালো না হলে ওল্ডহোম ক্লিনিক আছে , সেখানকার উন্নত চিকিৎসায় তোমার মা’ ভালো হয়ে যাওযার কথা। রোদ্র আমাকেও ডেকেছিল তার মায়ের সাথে রংধনুর বিয়ে বিষয়ে কথা বলার জন্য। আমি গিয়েছিলামও।
কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো যে ঝুমা কোন মতেই চায়না যে তার মেয়ের বিয়ে হোক। সে এক বারও বলে না যে মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে বিয়ে দেয়া দরকার। উল্টো আরো বলে, এখনই বিয়ের কি হয়েছে। আরো কত সুপাত্র পাওয়া যাবে। তখন দেখা যাবে।কেউ তার মেয়ের বিয়ে নিয়ে কথা বললেই সে মেজাজ দেখায়। অবশ্য তার মেজাজ সবসময় খিটখিটে হয়েই থাকে। কি চায়, কি চাচ্ছে? এটা অনুধাবন করাই মুশকিল। ছেলের বউয়ের সাথেও সবসময় ক্যাচক্যাচ খ্যাচ খ্যাচ লেগেই আছে। কারো সাথেই বনে না। একবার আমি তাকে দেখতে গেলে সে সবার বিরুদ্ধে অভিযোগের ডালি নিয়ে বসে। কতজনের বিরুদ্ধে যে তার নালিশ। আমি শুধু শুনেই গেলাম আর হু হা করে গেলাম। কারণ তার মতের বিরুদ্ধে গেলেই তার গলার স্বর চড়ে যাচ্ছে উচ্চ পারদে।
তখন আমার মনে হলো যে, সতিনের সংসারে সে শুধু হিংসার প্রাকটিস করেছে আর তা নাহলে তার কিছু সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম হয়েছে। কারণ সেই আগের হাসিখুশি প্রাণবন্ত ঝুমা তো আর নাই। তার সেসব গুনপনার প্রাকটিসও আর ছিল না। এখন তো সে অসুখে বিসুখে জর্জরিত হিংসুটে স্বার্থপর কুটনি একজন অচেনা ঝুমা। শুধু তার সেবার ব্যাঘাত হবে দেখে সে মেয়ের বিয়ে দিতে চায়না। যে মেয়ে বান্ধবীর জন্য নিজ হাতে ড্রেস তৈরী করে দেয়,ফুল ভালোবাসে ফুলের যত্ন করে, ভাবো সেই মেয়ের কি রকম অন্ধ স্বার্থপরতা! পুরোই পাল্টে গেছে সে। যাহোক তার ছেলে, রতন আর তার ভাইয়েরা সবাই মিলে খুব করে বোঝানোর চেষ্টা করে ঝুমাকে যে সব সময় সুপাত্র পাওয়া যায় না। এই বিয়েতে তার অমত করা ঠিক হবে না। সবার জোরাজুরীতে একসময় সে মেয়ের বিয়েতে সম্মতি জানায়।
রতন আর তার ছেলে খুব জমকালো আয়োজন করে রংধনুর বিয়েতে। হলুদের অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে গানের ব্যান্ডদল ভাড়ায় নিয়ে আসে, বিশাল জাকজমক ব্যাপার । বরযাত্রীর দিন পুরো গ্রামের লোককে দাওয়াত খাওয়ায়। এগারোটা গরু আর ২৫টা খাসি জবাই দেয়। মেয়ে বিদায় দিতে দিতে রাত দেড়টা বেজে যায় প্রায়। হুইল চেয়ারে বসেই ঝুমা মেয়েকে মেয়েজামাইর হাতে শপে দিয়ে কাঁদতে থাকে। তার দেখাশোনার দায়িত্বেরত রফিকা নামের মেয়েটা কান্নারত ঝুমাকে একটু দূরে ফাঁকা জায়গায় রেখে সেও বধু বিদায়ের দৃশ্য দেখার জন্য হল রুম ছেড়ে বাইরে গিয়েছিল। তখন সাউন্ড বক্সে বাজছে সানাইয়ের করুন সুর। কিছু ছোটবাচ্চারা মঞ্চের সাজানো ফুল আর ছোট ছোট বেলুনগুলো ছিড়ছে। হল্লা করছে। বয়স্ক কয়েকজন ঝুমার হুইল চেয়ারের আশেপাশে আছে তারা গল্প করছে আর পান চিবাচ্ছে। প্রায় পনেরো /বিশ মিনিট এমন করে কেটে যায়। এরপর রফিকা এসে দেখে যে ঝুমা ঘেমে ধুয়ে গেছে। তাকে কেমন যেন মনে হচ্ছে সে দৌড়ে যেয়ে ঝুমার ছেলেকে ডেকে আনে। সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে বাড়ির একটা মাইক্রোতে করে তাকে হার্ট ফাউন্ডেশনে নিয়ে যাওয়া হয়।
রাত তিনটার দিকে কর্তব্যরত ডাক্তার বলে যে, ’ম্যাসিভ হার্ট এটাক’। সরি রোগিকে বাঁচানো গেলনা। কনা আপা বলল,’ আমি তো বিয়েতে মেয়ে বিদায় পর্যন্ত ছিলাম না, আগেই চলে এসেছিলাম। তাই খবরটা জানলাম ভোর বেলা ফজরের ওয়াক্তে। খবরটা শুনেই তখন আমার মনে হলো,
’আহা মানুষের চাওয়াতেই কি সব হয়,
উপরওয়ালার সম্মতি বিনে কিছুই হওয়ার নয়।
যেন একটা উজ্জল নক্ষত্রের পতন হলো। ঝুমা অধ্যায়ের শেষ হলো’।