ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গরিব মানুষের জন্য গণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ করেন। তিনি সারা জীবন মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করে গেছেন এবং দেশের মঙ্গলের কথা ভেবেছেন। দেশের কথা না ভাবলে একদিকে সুন্দর জীবনের হাতছানি অন্য দিকে শূন্য হাতে গরীব দুঃখীর জন্য কাজ করা। আর তিনি গরীব-দুঃখীর সাথে কাজ করার জীবনকেই বেছে নিলেন।
গোলাম মোর্তেজার একটি লেখা থেকে আমরা জানতে পারি যে- বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। পিতামাতার ১০ ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। তিনি ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তার জীবন বর্ণাঢ্য, বৈচিত্র্যময়, কিছুটা বিচিত্রও বটে। ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাস করে এফআরসিএস পড়তে গিয়েছিলেন লন্ডনে। তখন তার জীবনযাপন ছিল রাজকীয়। প্রাইভেট জেট চালানোর লাইসেন্স ছিল; দামি স্যুট, টাই, শার্ট, জুতা পরতেন। ৪ বছরের এফআরসিএস কোর্স শেষের দিকে। প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, সপ্তাহখানেক পরেই ফাইনাল পরীক্ষা। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। সে সময় তিনি প্রতিবাদ স্বরুপ পাকিস্থানী নাকরিকত্বের পাসপোর্ট ছিড়ে ফেলেন। তিনি পরীক্ষা না দিয়েই দেশে এসে মানুষের সেবাই নিজেকে নিয়োগ করেন।
মে মাসের শেষে তারা পৌঁছালেন আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরে। সেখানেই গড়তে তুললেন একটি হাসপাতাল। সেই হাসপাতালটিই স্বাধীন বাংলাদেশে জন্ম নিলো গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামে। যার আদি জন্ম ১৯৭১ সালে ভারতের মাটিতে, আগরতলার বিশ্রামগঞ্জে। মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফ এই অঞ্চলে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন। যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য গড়ে তোলা হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল'। ছন-বাঁশ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল ৪৮০ শয্যার হাসপাতাল, অপারেশন থিয়েটার। যুদ্ধে গুরুতর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জটিল অপারেশনও করা হতো বাঁশের তৈরি এই হাসপাতালে।
হাসপাতালটি গড়ে তোলার অন্যতম উদ্যোক্তার নাম ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও তৎকালীন পাকিস্তানের একমাত্র কার্ডিয়াক সার্জন ডা. এম এ মবিন। প্যারামেডিক প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল একদল সেবাদানকারী। মানবাধিকার কর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামালও তাদের একজন। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে হাসপাতালটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়ার সময় নাম নিয়ে আপত্তি এলো প্রশাসনের পক্ষ থেকে। সেই সময় অন্য অনেক বিষয়ের মতো এটাও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কান পর্যন্ত পৌঁছাল। ডা. জাফরুল্লাহ সচিবালয়ে গিয়ে দেখা করলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রছন্দে হাসপাতালের নাম রাখা হয় গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র। যার লোগো করেন বিখ্যাত শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। জোহরা বেগম, পাকিস্তান সরকারের যুগ্ম সচিব এম এ রব এবং ডা. লুৎফর রহমান সাভারে তাদের পারিবারিক সম্পত্তি থেকে ৫ একর জায়গা দিয়েছিলেন হাসপাতালের জন্য। বঙ্গবন্ধু আরও ২৩ একর জমি অধিগ্রহণ করে দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠান 'বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল' পরিবর্তিত ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামে যাত্রা শুরু করল ১৯৭২ সালে।
তিনি নিজে যখন কিডনি রোগে আক্রান্ত হলেন তখন তিনি চাইলে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আনতে পারতে কিন্তু তিনি তা করেননি। কারণ দেশের বাইরে গেলে তার নিজের সাথেই তাকে বেইমানী করা হবে। তাই তিনি নিজের দেশেই নিজের প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা করিয়েছেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র সাধারণ জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে তিনি নতুন নতুন নিয়ম করে দেশের মঙ্গলের কাজ করার প্রত্যায় ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি নারীদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। তিনি সব সময় ঝুকি গ্রহণ করতে পছন্দ করতেন। নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ইলেকট্রিশিয়ান, কারপেন্টার, ওয়েল্ডার হিসেবে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। ড্রাইভার হিসেবে নারীদের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রই প্রথম সামনে নিয়ে আসে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নারী ড্রাইভাররা বড় বড় জিপ চালাতে শুরু করেন ১৯৮২ সাল থেকে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মী সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৫০০, এর মধ্যে অন্তত ৪০ শতাংশ নারী। তিনি নারীদের পুলিশে নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনিই ভূমিকা রেখেছিলেন। অনেক খবরই আমাদের অজানা।
স্বাধীন দেশে ডা. জাফররুল্লাহ চৌধুরীর ওষুধ নীতি প্রণয়ন করেন। দেশে কিছু ওষুধ তৈরি হলেও অধিকাংশ ওষুধ অন্য দেশ থেকে আনা হত। তিনি দেশীয় ওষুধ তৈরির উপর গুরুত্ব দেন এবং অপ্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রণের জন্যই এই ওষুধ নীতি প্রণয়ন করেন। দেশীয় ওষুধ শিল্প গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে কম দামে ওষুধ আমদানির প্রস্তাব বিবেচনায়ও নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশীয় ওষুধ শিল্প ও নীতির বিষয়টি বুঝিযয়েছিলেন জিয়াউর রহমানকেও। জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ তার মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে ওষুধ নীতি নিয়ে কাজ করুক। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতাবিরোধী শফিউল আযমদের সঙ্গে নেওয়ায় ৪ পৃষ্ঠার চিঠি লিখে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান ডা. জাফরুল্লাহ। পরবর্তীতে এরশাদকে বুঝিয়ে ওষুধ নীতি করাতে সক্ষম হন ১৯৮২ সালে। সাড়ে ৪ হাজার ওষুধ থেকে প্রায় ২ হাজার ৮০০ ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়। অনেকে জিয়ার সাখে তার ভাল সম্পর্কের কথা বলেন আসলে সবার সাথেই তো তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল আবার কাউকে খারাপ কাজ করতে দেখলে সমালোচনাও তো কম করেননি। তিনি তাদের সাথে সম্পর্ক ভালো রেখে তো নিজের স¦ার্থ হাসিল করেননি। তিনি নিজের দেশের গরীব দঃখীর জন্য স্বাস্থ্য সেবার নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। দেশের কল্যানে কাজ করে গেছেন। ‘১৪-১৫ বছর ধরে ছেড়া শার্ট পরিধান করতেন। নিজে বিলাসবহুল জীবন ত্যাগ করে বেছে নেন সন্তের জীবন। তার মধ্যে কোন বড়ত্ব ভাব ছিল না। যে মানুষ গরিব দুঃখীদের নিয়ে কাজ করবেন তিনি আরাম আয়েশের জীবন কিভাবে গ্রহণ করবেন। যার একসময় জীবন ছিল বিলাসীতায় ভরপূর সেই মানুষ সবকিছু ছেঁড়ে ছুঁড়ে চলে আসলেন দেশের টানে দেশের কাজ করবেন বলে নিজের পরীক্ষা না দিয়ে সুখের ভবিষ্যতের জীবনকে প্রত্যাখান করে বেছে নেন এই জীবন।
গণ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষাকে তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা-যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিভাগটির নামকরণ করেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তাঁর স্বপ্ন ছিলো, মাতৃভাষা-মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস প্রতিটি শিক্ষার্থীর ভালোভাবে জানবে এবং তার চর্চা করবে। ১৯৮৭Ñ৮৮ সনে গাজীপুরের শ্রীপুরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ক্যাম্পাসে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কেমন বিশ্ববিদ্যালয় হবে এ নিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সিনিয়র কর্মীদের সঙ্গে একটি কর্মশালা করেন, তখন কর্মীদের মনোভাবের বিষয়টি গ্রহণ করে তিনি পরবর্তীতে নব্বইয়ের দশকে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে আলোচনা ও কর্মশালার মাধ্যমে একটি কনসেপ্ট পেপার তৈরি করেন, যেটিই বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসেপ্ট পেপার হিসেবে পরিচিত। সেটি পড়লেই জানা যায় ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল কত পরিষ্কার। আগে কোন শিক্ষক বা কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হলে নিয়োগ পত্রের সঙ্গে কনসেপ্ট পেপারটিও দেয়া হতো, পড়ে বুঝে সেইমতো অনুসরণ করার জন্যে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্বপ্ন ছিল গণ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা-যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিষয়ক একটি ইনস্টিটিউট খোলার সেটা সম্ভবত গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ ছিল। ভাষা-যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিভাগের অধীনে প্রথম দিকে ইংরেজি বিভাগ, তারপর বাংলা বিভাগ। আস্তে আস্তে ইংরেজি বিভাগের ছাত্রবৃদ্ধি পাওয়ার পর ইংরেজি বিভাগ আলাদা হয়ে গেলো। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি বিভাগে সহায়ক কোর্সে হিসেবে বাংলা পড়ানো হয়। যেমন : বর্তমানে গণ-তে মোট ১৭টি বিভাগের মধ্যে ২টি বিভাগ ব্যতীত (ভেটেরিনারি এণ্ড এনিমেল সায়েন্সেস অনুষদ, কৃষি অনুষদ) ১৫টি বিভাগে বাংলা ভাষা, সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক কোর্স পড়ানো হয়। সময়ের পরিক্রমায় গণ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পরবর্তীতে ভাষা-যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিভাগকে বাংলা বিভাগ রূপদান করা হয়।
গরিব মানুষের কাছে সুলভে মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া তার কর্মকাণ্ডের মূল সুর ছিল। নিজে ডায়ালাইসিসের রোগী হয়ে আবিষ্কার করলেন এক বিরাট অভাবের ক্ষেত্র। অসুস্থ হয়ে যখন তিনি সপ্তাহে ৩ বার ডায়ালাইসিস করছেন, তখন উদ্যোগ নিলেন ডায়ালাইসিস সেন্টার প্রতিষ্ঠার জন্য। এটি তিনি নিজের সুবিধার জন্য করবেন না, গরিব মানুষকে অত্যন্ত সুলভ মূল্যে ডায়ালাইসিস করার সুযোগ দেওয়ার জন্য। এভাবেই এই স্বপ্নবাজ মানুষ সমাজের নিঃস্ব, অবহেলিত মানুষকে হাত ধরে তুলে ধরতে চেয়েছেন। তিনি ভাল করেই জানতেন একটা সমাজ বা রাষ্ট্রকে পরিবর্তন করতে হলে সেই দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে পরিবর্তন করতে হবে আর সেপথেই হেঁটেছিলেন স্বপ্নের পুরুষ জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি গাছকে বাঁচাবেন বলে তার গণ স্বাস্থ্র কেন্দ্রে কাঠের ফার্নিচার বানানো থেকে দূরে রাখা হয়েছিল। তিনি গরিব দুঃখীর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা করেন। তিনি ছিলেন নিজের বিশ্বাসের উপর একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ। তিনি সব সময় চলেছেন স্রোতের বিপরীতে আর এই স্রোতের বিপরীত চলা মানুষের সংখ্যা পৃথিবীকে হাতে গোনা। এবং তারাই তো পৃথিবীকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে পেরেছেন।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক