আমি বই পাগলা মানুষ। যেখানে বইয়ের গন্ধ পাওয়া যায় সুযোগ পেলেই সেখানে ছুটে যায়। শৈলকুপা উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম গোলকনগর যেখানে কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক বঙ্গ রাখালের বাড়ি। তিনি নিজ বাড়িতে পিতার স্মৃতিতে গড়ে তুলেছেন একটি সম্বৃদ্ধ পাঠাগার। গোলাম রসুল স্মৃতি পাঠাগার। এই পাঠাগারে আমার যাতায়াত প্রায় দু বছর হলো। কোন একটি উপলক্ষ পেলেই ছুটে যায় বইয়ের গন্ধ নিতে। জানতে পারলাম ১৪ ডিসেম্বর মহান শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে শিশু কিশোরদের বইয়ের সাথে পরিচিত করতে এবং শহিদ বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগের প্রতি সন্মান জানাতে দিনব্যাপী একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসের সাথে যুক্ত করা হয়েছে সাধক ফকির লালন সাঁইয়ের চর-চড়িয়ার আখড়া পরিদর্শনও। যে আখড়াটি এখন জবর দখলের তাণ্ডবে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান গবেষক মোঃ রাশিদুজ্জামান, ছোট কাগজ লেখমালা'র সম্পাদক মামুন মুস্তাফা, সাংস্কৃতিক সংগঠক ও উদীচী ঝিনাইদহ জেলার সভাপতি কেএম শরীফ, বীর মুক্তিযোদ্ধা কবি ও গীতিকার ননী গোপাল বিশ্বাস, কবি সামসুজ্জামান লাভলু, নিভৃতচারী গীতিকবি হাসানুজ্জামান, বাচিক শিল্পী মাজেদ রহমানসহ এক ঝাঁক শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিকজন। এমন একটি মহতী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেলে কি ঘরে বসে থাকা যায়? অগত্যা ১৪ ডিসেম্বর সকালে ছুটে গেলাম গোলক নগরে। গোলক নগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আয়োজন করা হয়েছে অনুষ্ঠান। বিদ্যালয়ের বারান্দায় বইয়ের ডিসপ্লে। বিদ্যালয়ে আগত কোমলমতি শিশুরা বই নেড়েচেড়ে দেখছে, পড়ছে আমার কাছে এই দৃশ্য স্বর্গ দর্শনের সমান উপভোগ্য।
যথা সময়ের একটু পরে শুরু হলো শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনা সভা। আলোচনা সভা বলতে আমরা যা বুঝি তা হলো ভারী ভারী শব্দে বাক্যবাণ কিন্তু আজকের আলোচনা সভা হলো ভিন্ন। খুব সহজ ও সাবলীল ভাষায় শিশু কিশোরদের বুদ্ধিজীবী দিবসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। খুব চমৎকার আলোচনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও গবেষক মোঃ রাশিদুজ্জামান, বীর মুক্তিযোদ্ধা কবি ননী গোপাল বিশ্বাস, কবি মামুন মুস্তাফা, ড. মো. এরশাদুল হক, সহকারী অধ্যাপক, (ফোকলোর স্টাডিজ বিভাগ), ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া, মো : মোকাদ্দেস হোসেন, প্রধান শিক্ষক, গোলকনগর সর: প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রমুখ।
প্রথম সেশন শেষে শুরু হলো কবিতাপাঠ ও সাহিত্য আলোচনা। কবিতা পাঠ করলেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা এর ভাসকুলার সার্জারী বিভাগ, সহযোগী অধ্যাপক, কবি ডা. শামীম রেজা, লেখমালার সম্পাদক কবি মামুন মুস্তাফা, কবি ও গীতিকার ননীগোপাল বিশ্বাস, কবি সামসুজ্জামান লাভলু, কবি হাসানুজ্জামান, কবি সজল রায়,কবি মো. আবুল হাসনাত হাবিবুল্লাহ প্রমুখ। বাচিক শিল্পী মাজেদ রহমান ভাইয়ের দরাজ কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি সবাইকে সম্মোহিত করে রেখেছিলো দীর্ঘক্ষণ।
কবিতা পাঠ ও সাহিত্য আলোচনা শেষে সময় হলো মধ্যাহ্ন ভোজনের। কবি বঙ্গ রাখালের বাড়িতে ভূরিভোজের আয়োজন করা হয়েছিলো একদম দেশি খাবারের সমাহারে। কাঁচা কলা ভর্তা, মাছ ভাজা, বেগুন ভাজি, মাশকালইয়ের ডাল, সালাদ আর ভাত। খুবই চমৎকার আয়োজন। কবি গিন্নীর রান্নার হাতের তারিফ না করলে তার সাথে অন্যায় করা হয়ে যাবে।
ভূরিভোজন শেষে এবার চর-চড়িয়ায় লালন সাঁইজির আখড়া পরিদর্শনের পালা। নিজেদের মোটর বাইক ও অটোভ্যানযোগে সবাই পৌঁছে গেলাম চর-চড়িয়ার আখড়ায়। আখড়া বলতে এখন আখড়ার অস্তিত্ব নেই। প্রায় সবই দখল হয়ে গেছে কয়েক কবর অপেক্ষা করছে সর্বনাশের শেষ পেরেকের আঘাত পাওয়ার। জানা যায় লালন সাঁইয়ের আখড়া গুলোর মধ্যে চর-চড়িয়ার আখড়া ছিলো সবচেয়ে বড়। লালন সাঁই এই আখড়ার দায়িত্ব তাঁর শিষ্য শুকুর শাহের কাছে অর্পণ করে ছেউড়িয়া চলে যান। পরবর্তীতে শুকুর শাহের বংশধরেরা আখড়াটি ধরে রেখেছিলেন। স্থানীয়দের থেকে জানা যায় দুই তিন দশক আগেও এখানে সাধুসঙ্গ হতো কিন্তু বর্তমানে তা বন্ধ আছে। আলাপ হয় শুকুর শাহের বংশধর টুলু শাহের সাথে। তিনি এখন আখড়ার পাশে একটি চায়ের দোকান চালিয়ে পরিবার নির্বাহ করেন। চমৎকার একটি দিনের গোধূলি লগ্নে কিছু হতাশা নিয়েই ঘরে ফিরলাম। তবে আমাকে আশা দেখিয়েছে গোলাম রসুল স্মৃতি পাঠাগার এবং বইয়ের প্রতি আগ্রহী শিশু কিশোরদের উজ্জ্বল চোখ। আমার বিশ্বাস আমাদের সুদিন ফিরবেই ফিরবে।