অস্ট্রেলিয়ার লাল সূর্যটা সোনালি আভা ছড়াচ্ছিল নিউ সাউথ ওয়েলসের আকাশে। সেদিন ছিল সিডনীতে আমার প্রথম সকাল , যদিও ২য় দিন। নিউ সাউথ ওয়েলসের এই শহরটির নাম মিন্টো। মিন্টো থেকে ট্রেনে যেতে যেতে বিভিন্ন ষ্টেশনের নাম মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম । ওলয় ক্রীক নামটি শুনতে আমার সবচে ভালো লাগছিল। আমাদের গন্তব্য সার্কুলার ক্যুয়ে ।
সার্কুলার ক্যুয়ে পার হয়ে ডান দিকে গেলেই পৃথিবী বিখ্যাত সেই নাম , অপেরা হাউজ। সিডনী অপেরা হাউজ। অপেরা হাউজ দেখেছি কত শত বার , তবে ছবিতে। ছোটবেলায় অপেরা হাউজ বলতে দুনিয়াতে ওই একটাই মনে করতাম।
আজ কল্পনার আর ছবির সেই অপেরা হাউজের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাত । দিনটিকে স্মরণীয় বলা বাহুল্য বটে । অসংকোচে বলি, অস্ট্রেলিয়ায় কাটানো ৩৪ দিন আমার জীবনের সেরা । কেন নয়? কি নেই অস্ট্রেলিয়ায়, শান্তি , ফুর্তি , প্রাণ, সততা, স্বাচ্ছন্দ্য , শৃঙ্খলা , সৌন্দর্য? কোন কিছুরই তিল পরিমাণ কমতি নেই। রাষ্ট্র নগর গুলোকে , পুরো দেশটাকেই থরে থরে সাজিয়ে রেখেছে নাগরিকদের জন্য। কাজ কর আর জীবনকে ভোগ কর নিরাপদে, আমোদে , আনন্দে। নগর ও নাগরিকের পারিস্পরিক বিশস্ততা আমাকে আশ্বস্ত করে এখানে প্রতি পদে।
সে যাই হোক , কাছে যেতেই ধরা দিল সৌন্দর্যের তীর্থ সিডনী হারবার। তাকিয়ে ছিলাম, চোখে ছিল বিস্ময়, চেহারায় মুগ্ধতা, মনে প্রশান্তি স্পষ্ট অনুভব করলাম। সিডনী হারবার আর অপেরা হাউজের পাশাপাশি অবস্থান একদিকে সিডনী কে করেছে ধনীর ধনী, অন্যদিকে পর্যটকদের কাছে লোভনীয়। ত্রিমাত্রিক সৌন্দর্যে সিডনীকে ভরিয়ে অপেরার হাউজের পাশেই দাঁড়িয়েছিল হারবার ব্রিজ। কি ভয়ানক উঁচু সে; যেন আকাশের সাথে না মিশলে তার চলছেই না। এত সুন্দর তার নকশা যে মনে হচ্ছিল হারবারের অলঙ্কার সে , না জন্মালে হারবার যেন অসম্পূর্ণ রয়ে যেত। দূর থেকে দেখা যায় তার গায়ে ছোট ছোট পিঁপড়ে হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে হাজার গাড়ি। শুধু তা কেন? ভয়ানক সাহসী কিছু আরোহী বিশেষ পথে উঠেই গেল আকাশচুম্বী হারবার ব্রিজে । গগন ছুঁয়ে থাকার মুহূর্ত গুলো কেউ ক্যমেরাবন্দী করতে ভুলছিল না।
সিডনী হারবার ছাড়া ও আর কয়েকটা হারবার মিলে জায়গাটিকে বলা হয় পোর্ট জ্যকসান। ইউরোপিয়দের হাতে আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৭৮৮ সালে। সাউথ প্যাসিফিক থেকে বেরিয়ে তাসমান সাগরের একটি জলরাশি ভুমি ছুয়ে সৃষ্টি করেছিল এই হারবার ,যা পৃথিবীর সবচে বড় প্রাকৃতিক হারবার বলে পরিচিত। বছরকে স্বাগত জানাতে এই হারবার প্রতি বছর সাজে চোখ ধাঁধানো সাজে। লাখ লাখ পর্যটকের মন কাড়তে হারবার একদম প্রস্তুত, কি বিশাল তার আয়তন ! হারবার প্রেমীরা সবদিক থেকে দেখার জন্য মাইলের পর মাইল একবেকে চলে গেছে তীর ঘেঁষে পাথুরের রাস্তা।এত অপরূপ শোভা আমার ভেতরে শত বছরের প্রাণ বায়ু সঞ্চার করেছে যেন।
সিডনী হারবারের কোল ঘেঁষে দাড়িয়ে আছে বিখ্যাত অপেরা হাউজ। নির্মাণ শৈলী তার স্থাপত্য বিদ্যার চমৎকার বললে কম হয়ে যায়। এই একটি মরা দালান সিডনীকে পুরো পৃথিবীর কাছে করে রেখেছে জীবন্ত। দূর থেকে মনে হয়েছে পানির উপর ভাসমান একটি বিশালাকৃতির সাদা জবা ভাঁজ খুলে আছে।ভাঁজে ভাঁজে বসেছে রঙের মেলা। কাছে যেতেই স্পষ্ট তিনটি বিশাল আলাদা অংশ। অনেক গুলো সিঁড়ি পার হয়ে উপরে উঠে সমানের দিকের অংশটি একটি রেস্টুরেন্ট ।বাকি দুটোতে অপেরার আসর বসে। অপেরা হাউজটি দৈত্যাকার, ব্যাস , ব্যাসার্ধ খুজে বের করার চেশ্ঠা করিনি।
হারবারের এক কোণা দিয়ে চলে গেছে রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেন।মনে হয় হারবারের সৌন্দর্য দেখতে এসে প্রেমে পড়ে নিজেই রয়ে গেছে চিরদিনের মত। আমি মুগ্ধ! মানুষকে কি অসাধারণ করেই না তৈরি করা হয়েছে! সুদূর ইউরোপ থেকে ওরা কীভাবেই যে এমন ভুখন্ড খুজে বের করলো, পাথরে ফুল ফোটাল , অস্ত্রেলিয়া বানাল, সিডনী বানাল। ইউরোপীয় থেকে অজি হল! মানুষকে তাক লাগিয়ে দেবার সব কৌশল এদের জানা। সবুজে সবুজে ঢেকে দিয়েছে হারবারের কিনারা। মাঝে মাঝেই বসার জন্য কাঠের বা পাথরের চেয়ার। কত রকমের গাছ-গাছালী, নানান বর্ণের বক পাখিগুলো হেঁটে বেড়াচ্ছে নির্ভয়ে । পর্যটকেরা ঘুরছে ফিরছে সবখানে। পুরো হারবার জুড়ে অজিগুলো দাপিয়ে বেরাচ্ছে, কেউ তীরে ছুটে ছুটে ব্যায়াম করছে। আমি পুলকে নীরবে শুধু চেয়েই রইলাম বিকেল পর্যন্ত।
কবি ও গল্পকার
শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়