আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিকে বাদ দিলে ‘৫০ শতাংশ মানুষের জাতীয় ঐক্য’ হবে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। প্রধান উপদেষ্টা যে বৈঠক করেছেন, তাতে নিবন্ধিত বেশিরভাগ দল বাদ পড়ায় এতে ‘জাতীয় অনৈক্যের সূচনা’ হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
শনিবার জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে এক আলোচনায় জাতীয় পার্টির নেতা এসব কথা বলেন।
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের দিনটির স্মরণে এই সভার আয়োজন করা হয়। দিনটি তারা পালন করে ‘সংবিধান সংরক্ষণ’ দিবস হিসেবে।
জি এম কাদের বলেন, “আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিকে বাদ দিলে দেশের ৫০ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী দলকে জাতীয় ঐক্যের ডাকের বাইরে রাখা হয়েছে। ৫০ শতাংশ মানুষের দলকে সংলাপের বাইরে রাখা হয়েছে। এতে জাতিগতভাবে অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। দেশে একটা অবিশ্বাস ও সংঘাতময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।”
২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনের ফলাফলও স্মরণ করেন জাতীয় পার্টির নেতা। তিনি বলেন, “২০০১ সালে বিএনপি ১৯৩টি আসন জিতে সরকার গঠন করেছিল। সেই নির্বাচনে বিএনপি ৪০.৯৭ ভোট পেয়েছিল। আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনে বিএনপির চেয়ে ১৩১ সিট কম পেয়ে খুব খারাপ ফলাফল করেছিল। আওয়ামী লীগের ভোটের হার ছিল ৪০.১৩। সেখানে ভোটের শতকরা ব্যবধান ছিল ১ শতাংশেরও কম।”
ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৪টি আসন ও ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ ভোট, জামায়াত ১৭টি আসন ও ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের ৪৮ দশমিক ০৪ শতাংশ ভোট এবং ২৩০টি আসন পেয়েছিল। জাতীয় পার্টি পেয়েছিল ২৭টি আসন। ভোটের হার ছিল ৭.০৭। সেই নির্বাচনে বিএনপির ভোট ছিল ৩২ দশমিক ০৫ শতাংশ, আসন ছিল ৩০টি।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা একটি জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সাথে মতবিনিময় করেছেন। এতে জাতীয় ঐক্যের নামে ‘জাতীয় অনৈক্যের’ সূচনা হল। ৪৮টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে মাত্র ১৮টি দলের সাথে মতবিনিময় করেছেন তিনি।
“৫০ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী দলকে বাদ দিয়ে সুন্দর দেশ গড়া বাস্তবসম্মত নয়।” দেশে ‘অরাজকতা ও অস্থিরতার বীজ বপন হয়েছে’ বলেও মনে করেন তিনি।
সংস্কারের নামে ‘প্রতিশোধ’
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান । বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার কি সবার মতামতের ভিত্তিতে সংস্কার করছে? এখন দেখা যাচ্ছে ঐক্যের চেয়ে প্রতিশোধের বিষয়টি সামনে আসছে।
“কেউ অপরাধ করলে বিচার করতে হবে, সরকার ‘প্রতিশোধপরায়ণ’ হলে বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। আইনে বলা আছে ১০টি অপরাধী ছাড়া পেলেও যেন একজন নিরপরাধ শাস্তি না পায়। আপনারা সেটা ফলো করছেন? হত্যা মামলায় লাখ লাখ মানুষকে আসামি করা হচ্ছে।”
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে বলেও দাবি করেন সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা। বলেন, “তারা হচ্ছে সরকারের শক্তির উৎস, শক্তিশালী হাতকে ‘লুলা’ করে দেওয়া হয়েছে।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকার সবসময় ‘সবার’ সমর্থনে সাফল্য পেয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “শরিয়া আইনেও আছে মানুষের বিচার করতে হবে তার নিয়ত দেখে, তার কাজ দেখে নয়। পুলিশের কিছু সদস্য চাকরি করে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য। তারা রাষ্ট্রের কর্মচারী হিসেবে সরকারের নির্দেশনা মানতে বাধ্য। ইচ্ছা করে সবাই শেখ হাসিনার অপকর্মে জড়িত হয়নি। সবাইকে ঢালাও করে অপরাধী করলেন, শত্রু বানালেন, বাদ দিলেন... এরমধ্যেই শূন্যস্থানগুলোতে পুলিশ ও প্রশাসনে দলীয়করণ হয়ে গেছে।”
‘শক্তিশালী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে’ অন্তর্বর্তী সরকার ‘জিম্মি’ হয়ে পড়েছে বলেও অভিযোগ করেন জি এম কাদের। তিনি বলেন, “মনে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার যা করতে চায়, তা করতে পারছে না।”
ব্যবসায়ীসহ সব পেশাজীবীরাও দেশের পরিস্থিতি দেখে চিন্তিত ও দুর্দশাগ্রস্ত পড়েছে বলেও দাবি করেন জাতীয় পার্টির নেতা।
‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা উচিত হবে না’
এমন অবস্থানের কথা তুলে ধরে জি এম কাদের বলেন, “আওয়ামী লীগের যারা দোষ করেছে তাদের তদন্তের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করুন। ‘আন্দাজে’ মামলা দিয়ে কাউকেই শাস্তি দেওয়া ঠিক নয়। একটি সংগঠনের সবাই কি অপরাধী?
“যদি তাই ভাবেন তাহলে শেখ হাসিনার সাথে আপনাদের তফাত কী? শেখ হাসিনা মনে করত ‘বিএনপি ও জামায়াত করলেই অপরাধী’, এখন তো আপনারা সেটাই করছেন। আমরা চাই আগামী নির্বাচনে সকল দল অংশ নিক। যাদের নিবন্ধন দিয়েছেন তাদের কেন নির্বাচনে আসতে দেবেন না?”
পুলিশ ও প্রশাসন এখন কার কথায় চলছে- এই প্রশ্নে রেখে জাতীয় পার্টির নেতা বলেন, “আমাদের লোকজন ভোট দিতে পারবে? আমাদের নেতাকর্মীরা নির্বাচনের মাঠে দাঁড়াতে পারবে?
“আওয়ামী লীগের মত কয়েকটি দল নিয়ে একতরফা নির্বাচন করে সব পাস করিয়ে দিলেন, সেটা কি টেকসই হবে? এমন সংস্কারে কি রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে? অস্থিরতা কি থামবে? দেশের ৫০ শতাংশ মানুষ নির্বাচন ও রাষ্ট্র সংস্কারের বাইরে রাখলে তারা কি বসে থাকবে?”
‘আমাদের সমর্থনকেও পদদলিত করেছে’
জাতীয় পার্টি সরকারকে সমর্থন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল মন্তব্য করে জি এম কাদের বলেন, “কিন্তু সরকার সেই সমর্থন পদদলিত করেছে।
“১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদাররা বলেছিল ‘আমরা মানুষ চাই না, মাটি চাই’। পোড়ামাটি নীতিতে মানুষকে গাদ্দার মনে করা হয়েছিল। শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল মিটিং করা সাংবিধানিক অধিকার। তা আমাদের দেওয়া হচ্ছে না। আমাদের পার্টি অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”
সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ চলছে মন্তব্য করে জাতীয় পার্টির নেতা বলেন, “সাংবাদিকরা ভয়ভীতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। নির্বিচারে আমাদের লোকদের ‘মিথ্যা মামলায়’ জড়ানো হচ্ছে। গ্রেপ্তার করা হচ্ছে কিন্তু জামিন দেওয়া হচ্ছে না, আমরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হচ্ছি।”
‘গলাবাজির দরকার নেই’
ভারতকে নিয়ে এক প্রশ্নে জিএম কাদের বলেন, “কোনো আগ্রাসন এলে স্বাভাবিকভাবেই আমরা তা প্রতিহত করব। এটার জন্য গলাবাজির দরকার নাই।
“কেউ কেউ বলেন, আগ্রাসন এলে এক ইঞ্চিও ছাড় দেব না। কে আপনাকে ছাড় দিতে বলে? আমাদের দেশে আর্মি আছে, বিজিবি আছেন না?”
আলোচনায় দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়াসহ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।