ড্র হওয়া সিরিজেও যে কখনও কখনও জয়-পরাজয় থাকে, সেটিই যেন ফুটে উঠল বাংলাদেশ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচে। জ্যামাইকা টেস্টে বাংলাদেশ নিজেদের রাঙাল তারা ১০১ রানের স্মরণীয় এক জয়ে।
প্রথম সেশনে জাকের আলির অসাধারণ ইনিংস পোক্ত করল দলের বিশ্বাস। পরে তাইজুল ইসলামের দুর্দান্ত বোলিংয়ে খাবি খেল ক্যারিবিয়ান ব্যাটিং। ১৫ বছর পর আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজে ধরা দিল টেস্ট জয়। আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের বর্তমান চক্রও তারা শেষ করতে পারল জয় দিয়ে।
জয়ের ভিত আগের দিনই গড়ে ফেলেছিল বাংলাদেশ। চতুর্থ দিনে মঙ্গলবার দলকে বলতে গেলে একাই টেনে নেন জাকের আলি। তার ৯১ রানের ইনিংসের সৌজন্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৮৭। কিন্তু তাদের ইনিংস গুটিয়ে যায় ১৮৫ রানেই।
৫০ রানে ৫ উইকেট শিকার করেন তাইজুল। ম্যাচে ৬ উইকেটের পাশাপাশি ব্যাট হাতে দুই ইনিংসেই অবদান রেখে ম্যান দা ম্যাচও তিনিই।
সকালে ৫ উইকেটে ১৯৩ রান নিয়ে দিন শুরু করে বাংলাদেশ। আগের দিনের দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যান জাকের ও তাইজুল আরেকটু এগিয়ে নেন দলকে।
কার্যকর এক বাউন্সারে তাইজুলের প্রতিরোধ ভেঙে এই জুটি থামান আলজারি জোসেফ।
আগের দিন অসুস্থতার কারণে ব্যাট করতে না পারা মুমিনুল হক অবশে ব্যাটিংয়ে নামেন আট নম্বরে। কিন্তু প্রথম ইনিংসের মতোই আউট হয়ে যান কোনো রান না করেই।
বাংলাদেশের রান তখন ৭ উইকেটে ২১১। জাকের খেলছেন ৭২ বলে ৩৯ রান করে।
জোড়া উইকেট হারানোর পর নিজের করণীয় বুঝে নেন জাকের। তৃতীয় টেস্ট খেলতে নামা ব্যাটসম্যান দারুণ পরিপক্কতার পরিচয় দিয়ে স্কিল আর পেশির জোরের প্রদর্শনী মেলে রান বাড়াতে থাকেন ঝড়ের বেগে। চার-ছক্কার স্রোতে ভেসে সেঞ্চুরির সম্ভাবনাও জাগিয়ে তোলেন তিনি।
ছক্কার চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত তার সেঞ্চুরিটা হয়নি তার। আউট হয়ে যান শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে। তবে ৮ চার ও ৫ ছক্কায় ১০৫ বলে ৯১ রানের ইনিংসটি বাংলাদেশের স্বপ্নের পালে দেয় জোর হাওয়া।
এ দিন বাংলাদেশ যে ৭৫ রান তোলে, এর ৬২-ই আসে জাকেরের ব্যাট থেকে।
এই মাঠে ২১২ রানের বেশি তাড়া করে জয়ের নজির নেই। সেখানে ২৮৭ রানের লক্ষ্য তো অনেক বেশিই। ওয়েস্ট ইন্ডিজও পারেনি নতুন ইতিহাস লিখতে।
লাঞ্চের ঠিক আগের ওভারে আক্রমণে এসেই বাংলাদেশকে প্রথম উইকেট এনে দেন তাইজুল। ৬ রান করে বিদায় নেন মিকাইল লুই।
ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক ক্রেইগ ব্যাথওয়েট অবশ্য বেশ ইতিবাচক শুরু করেন। স্বভাববিরুদ্ধ পথে হেঁটে আগ্রাসী কিছু শট খেলেন তিনি। ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে ছক্কা মারেন তাইজুলকে।
বাঁহাতি এই স্পিনার পরে ঠিকই শোধ তোলেন। তার তীক্ষ্ণ টার্ন ও বাউন্সে ৪৩ রানে বিদায় নেন ব্র্যাথওয়েট। এর আগেই কেসি কার্টিকে ফেরান তাসকিন আহমেদ।
পর তাইজুলের বিশাল টার্ন করা ডেলিভারিতে বোল্ড হন আলিক আথানেজ। যা একটু লড়াই করতে পারেন কেবল কাভেম হজ। তাকেও ৫৫ রানে থামান তাইজুল। জশুয়া দা সিলভাকে ফিরিয়ে তাইজুল পূর্ণ করেন পাঁচ উইকেট।
টেস্ট ক্যারিয়ারে এই স্বাদ পেলেন তিনি পঞ্চদশবার। এর মধ্যে দেশের বাইরে চতুর্থবার। দুটিতেই তার ওপরে আছেন বাংলাদেশে কেবল সাকিব আল হাসান।
এরপর কেবল শেষের অপেক্ষা। হাসান মাহমুদ এক ওভারেই ধরেন দুটি শিকার। শামার জোসেফকে দারুণ ইয়র্কারে বোল্ড করে ম্যাচের ইতি টানেন নাহিদ রানা।
প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ মাত্র ১৬৪ রান করার পরও লিড পেয়েছিল এই নাহিদের দারুণ বোলিংয়ে। তার হাত ধরে ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু, তার হাত দিয়েই জয়ের পূর্ণতা।
মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে জয়, আরও আগে দেশের শততম টেস্টে শ্রীলঙ্কায় হয় কিংবা এই বছরে পাকিস্তানে দুটি জয় হয়তো এখনও ওপরেই থাকবে। তবে নিয়মিত অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত ও অভিজ্ঞতম ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিমকে ছাড়া এই জয়, প্রথম টেস্টে হেরে কোণঠাসা হয়ে পড়া অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে এই জয়ও বিশেষ কিছু।
দেশের ক্রিকেটে ছোটখাটো একটি রেকর্ডও হয়েছে এই জয়ে। এই প্রথম এক পঞ্জিকাবর্ষে দেশের বাইরে তিনটি টেস্ট জিততে পারল বাংলাদেশ।
টেস্ট সিরিজ শেষে এবার ওয়ানডের লড়াই। সেন্ট কিটসে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ শুরু আগামী রোববার।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ১৬৪
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১ম ইনিংস: ১৪৬
বাংলাদেশ ২য় ইনিংস: ৫৯.৫ ওভারে ২৬৮ (আগের দিন ১৯৩/৫) (জাকের ৯১, তাইজুল ১৪, মুমিনুল ০, হাসান ৩, তাসকিন ০, নাহিদ ১*; সিলস ১৫.১-৩-৪৬-১, আলজারি জোসেফ ১৫.৫-১-৭৭-৩, শামার জোসেফ ১২-০-৮০-২, গ্রেভস ৮-১-২০-১, হজ ১-০-৪-০, রোচ ১০-০-৩৬-৩)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২য় ইনিংস: ৫০ ওভারে ১৮৫ (ব্র্যাথওয়েট ৪৩, লুই ৬, কার্টি ১৪, হজ ৫৫, আথানেজ ৫, গ্রেভস ২০, জশুয়া ১২, আলজারি জোসেফ ৫, রোচ ৮, সিলস ১*, শামার জোসেফ ৮; হাসান ৬-০-২০-২, তাসকিন ১০-০-৪৫-২, তাইজুল ১৭-৫-৫০-৫, নাহিদ ৯-২-৩২-১, মিরাজ ৮-০-৩১-০)।
ফল: বাংলাদেশ ১০১ রানে জয়ী।
সিরিজ: দুই ম্যাচের সিরিজ ১-১ ড্র।
ম্যান অব দা ম্যাচ: তাইজুল ইসলাম।
ম্যান অব দা সিরিজ: তাসকিন আহমেদ ও জেডেন সিলস।